বই: সত্যজিৎ ১০০
লেখক: উজ্জ্বল চক্রবর্তী
সংকলক: বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনা: সিমিকা পাবলিশার্স
মূল্য: ৪০০/-
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু চাকী
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৬
হার্ডকভার
নিজস্ব রেটিং:৪.৫/৫
বাপরে বাপ্!! দু' সপ্তাহ লেগে গেল এই ২১৬ পাতার বইটা পড়তে। জানি আপনারা বলবেন হুঁহুঁ বাবা সত্যজিৎ রায়কে বোঝা কী এতই সোজা— মোট্টেও না সত্যজিৎ রায়কে দেখা বা পড়া সোজা হলেও তাঁকে যখন বিশ্লেষণ করা হয় সেটা বোঝা বিলক্ষণ চাপের।
সত্যি বলছি এই ধেড়ে বয়সেও যখন 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' সিনেমা দেখি ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি যে রাজপ্রাসাদে গুপী বাঘার ঘরে ঝিরিঝিরি ঠান্ডা জলের ফোয়ারাটি আসলে দর্শকের বোরডম দূর করার শ্রী রায়ের একটি পন্থা। আমি তো ভেবেছিলুম (আদৌ পাত্তা দিয়েছিলুম কি!) রাজারাজরার ব্যাপার ঘরের মধ্যে ফোয়ারা কেন চৌবাচ্চাও এনে রাখতে পারে কিংবা শুন্ডীর রাজপ্রাসাদে সভাঘরের মেঝেয় আঁকা বিশাল প্রজাপতিটা সুন্দর দেখতে লাগে বলেই আঁকা কিন্তু তার পেছনে যে ফিবোনাচ্চি রাশিমালার অনুযায়ী অর্ধেক আপেলের কারসাজি আছে তা কে জানতো!
ADVERTISEMENT
যত পড়েছি তত যেন নাভিশ্বাস উঠেছে, ১৯৪৩ এর বাংলার কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ নিয়ে সত্যজিৎ রায় তৈরী করলেন 'অশনি সংকেত' সিনেমাটি। তার ৮ বছর পর বেরোলো অমর্ত সেনের লেখা 'পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন' এবং ৫০ বছর পর বেরোলো মধুশ্রী মুখার্জির বিস্তর গবেষণালব্ধ বই 'দ্য সিক্রেট ওয়ার অভ্ চার্চিল' যেখানে পরিষ্কার বোঝানো হল যে এই দুর্ভিক্ষ বৃটিশ সরকারের ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরী করা যাতে জাপানী সৈন্যরা বাংলার ওপর দিয়ে দিল্লি যেতে না পারে তাই হটাৎ বাজার থেকে চাল উধাও হল, কেউ বুঝলই না এর পেছনে কার চিন্তার প্যাঁচ যার ফলস্বরূপ মারা গেল ৫০ লক্ষ বাঙালি আর যা ছিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের তৈরী ষড়যন্ত্র!— যদিও শ্রী রায় সরাসরি এ তথ্য পরিবেশন না করে খুব ইনোসেন্টলি এক তরুণী গৃহবধূর চোখ দিয়ে দুর্ভিক্ষের আকারকে দেখালেন সেটাই পরে প্রমাণিত তথ্য আকারে বেরোলো।
শ্রী উজ্জ্বল চক্রবর্তী রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত গবেষক ও লেখক যিনি সত্যজিৎ রায় ও তাঁর কাজকে ভীষণ কাছ থেকে দেখেছেন যা তাঁর লেখার অনেক জায়গাতেই প্রতিফলিত হয়েছে এবং যাঁকে সত্যজিৎ বলেছেন—"উজ্জ্বল সিনেমার সিরিয়াস ছাত্র"। বইটিতে সত্যজিৎ রায়কে একদম আতস কাঁচ দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক যেখানে 'পথের পাঁচালি' শুটিং-এর প্রথম দিন হতবম্ভ সত্যজিতের কথা যেমনি আছে যিনি কিনা প্রথম শুটিং- এর দিন ভয় পেয়ে কাট বলতে ভুলে গেছিলেন তেমনি আবার ২৫ বছর বয়সে প্রথম ও শেষ ভারতীয় চিত্রশিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদশিল্পের বিশ্বপ্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার আনার কথাও আছে। সত্যজিতের ২০ বছর বয়সে মামাতো দিদির প্রেমে পড়াও আছে, আছে 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-র শুটিং চলাকালীন 'প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকায় এক প্রতিবাদী ছাত্রের লেখা 'সত্যজিৎ উদভ্রান্ত। তাই তিনি পালামৌয়ের জঙ্গলে অত্যন্ত নগ্ন একটি ছবি করতে ব্যস্ত'— এমন তিরস্কারেরও কথা!
বইটি লেখকের ২০টি প্রবন্ধ দ্বারা বিন্যস্ত। প্রথমেই আছে দু'পাতা জুড়ে তথ্যসূত্রের কৃতজ্ঞতা স্বীকার। বইটিতে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের মোটামুটি প্রতিটি গল্প, সিনেমা, চিত্রনাট্য, অঙ্কন, নান্দনিকবোধ, সংগীত, চরিত্রায়ণ, মনস্তত্ব, আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছু নিয়েই নাতিদীর্ঘ আলোচনা, রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের সব কর্মকান্ডেরই কার্যকারণ, চিন্তাভাবনার বিশদ অন্বেষণ যেখানে লেখক দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের এটা=ওটা, ওটা=এটা; একটি পরিপূর্ণ ব্যবচ্ছেদ। এবং এরসাথে উপরি পাওনা হিসেবে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের হাতে আঁকা সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত 'খেরোর খাতা' থেকে ৮টি ছবি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন স্বনামধন্য প্রচ্ছদশিল্পী শ্রী কৃষ্ণেন্দু চাকী যদিও প্রচ্ছদটি আর একটু ভালো হলে ভালো লাগতো বলে আমার ধারণা। বইয়ে দু-একটি জায়গায় যতিচিহ্নের সামান্য কিছু প্রিন্টিং মিসটেক ছাড়া আর কোন তেমন প্রমাদ আমার চোখে পড়েনি।
সত্যজিৎ-অনুরাগীরা এ বই পড়ে দেখতে পারেন নিরাশ হবেন না, শুধু প্রখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী কিংবা বিখ্যাত লেখক কিংবা অসামান্য সংগীত-রচয়িতা কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি শুধু কয়েকটি ভালো কথা নয় একদম ঘরোয়া সত্যজিৎ যার চলন্ত পাখার ব্লেডে কাটা আঙুলের ব্যথা থেকে অস্কারবিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পথ চলার পুরো ঘটনাই এখানে পাবেন।
শ্রী উজ্জ্বল চক্রবর্তীর "সত্যজিৎ ১০০" -র দ্বিতীয় খন্ডের অপেক্ষায় রইলাম।
0 comments